বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৭:২৬ পূর্বাহ্ন

লাফিয়ে বাড়ছে বিদেশী ঋণ

লাফিয়ে বাড়ছে বিদেশী ঋণ

স্বদেশ ডেস্ক:

দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সামগ্রিক বিদেশী ঋণ। মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে সার্বিক বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১৫.৪০ শতাংশ (এক হাজার ১২৮ কোটি মার্কিন ডলার) আর বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৩৭ শতাংশ (৫০৫ কোটি ডলার)। এই সময়ে বিদেশী ঋণের মধ্যে স্বল্পমেয়াদিই (এক বছরের কম) বেড়েছে ৪৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ (৪৫১ কোটি ডলার)। এর ফলে বিদেশী দায়দেনার বহির্মুখী প্রবাহ আকস্মিকভাবে বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যে হারে বিদেশী ঋণ বাড়ছে তা চলতে থাকলে সামগ্রিক আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিদেশী ঋণের সুদ আপাতদৃষ্টিতে সস্তা মনে হলেও ডলার টাকার বিনিময় হারের হিসাব করলে কার্যকর সুদহার অনেক বেড়ে যাবে। সেই সাথে দেশের ওপর বাড়বে সুদসহ বিদেশী ঋণের দায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে দেশে সরকারি- বেসরকারি মিলে সামগ্রিক বিদেশী ঋণ ছিল ছয় হাজার ৯৭৬ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে জুনে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৮০৩ কোটি ৮৯ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ৬ মাসের ব্যবধানে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৮২৭ কোটি মার্কিন ডলার আর ৯ মাসে বেড়েছে এক হাজার ১২৮ কোটি মার্কিন ডলার ।

সামগ্রিক ঋণের মধ্যে ছয় মাসে সরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৪৩৪ কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। গত ডিসেম্বেরে সামগ্রিক সরকারি বিদেশী ঋণ ছিল ৫ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার, গত জুনে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার। সরকারি ঋণের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণই বেশি বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে সরকারের কোনো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাড়েনি। যেমন, সেপ্টেম্বর ’২০ শেষে শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৫২৬ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩৬ কোটি মার্কিন ডলার।

এর মধ্যে গত ৯ মাসে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫০৫ কোটি ডলার। বেসরকারি ঋণের মধ্যে ৪০ দশমিক ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে এক হাজার ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্প মেয়াদে বিদেশী ঋণ ছিল ৯১৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, ৬ মাসের ব্যবধানে জুনে তা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ৬ মাসে এক বছরের কম সময়ের বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৩৬৭ কোটি ডলার।

বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের মধ্যে রয়েছে বায়ার্স ক্রেডিট, বকেয়া বিদেশী ঋণের কিস্তিজনিত চার্জ, বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাংক এলসি এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিট হলো বিদেশী দেশীয় কোম্পানি বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কেনে। বিপরীতে দেশীয় ব্যাংক বিদেশী ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের নামে ঋণ সৃষ্টি করে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করে। গত ৬ মাসে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়েছে ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার। অপর দিকে, দেশীয় ব্যাংক বিদেশী ব্যাংকের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে গ্রাহকের আমদানি দায় পরিশোধ করে, যা ব্যাংকিং ভাষায় ওবিইউ (অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট) বলে। গত ৬ মাসে এ ওবিইউয়ের মাধ্যমে ঋণ ৫০ কোটি ডলার বেড়ে হয়েছে ২৫১ কোটি ডলার। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গত ৬ মাসে প্রায় ৭০ কোটি ডলার বেড়ে হয়েছে ৬৮৯ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগে বেসরকারি উদ্যোক্তারা শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য বিদেশী ঋণ নিলে তিন মাস পর হতেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হতো। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ কমাতে ২০১৪ সালে এমন নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের চাপে এ নির্দেশনা সংশোধন করে নীতিমালা শিথিল করা হয়। এখন বিদেশী ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে সর্বোচ্চ এক বছর সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, কিস্তির পরিবর্তে একবারে পরিশোধ করলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর কিছুটা চাপ বাড়লেও স্বস্তিতে থাকবেন উদ্যোক্তারা। তারা বাড়তি সময় পাবেন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে।

জানা গেছে, টাকার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারছিল না ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে ২০১১ সালের দিকে ব্যাংকিং খাতের এ সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় স্থানীয় ঋণের সুদহারও বেড়ে যায়। এমনি পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেকটা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণের জন্য অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। রাতারাতি বাড়তে থাকে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ। সঙ্কটকালীন সময়ের জন্য এটা করা হলেও বৈদেশিক ঋণের লাগাম আর টেনে ধরতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের দায় প্রায় ১৯ বিলিয়ন অর্থাৎ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় অর্ধেক দায় সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত, ব্যবসায়ীরা এক বছরের কম সময়ের জন্য বা স্বল্পকালীন এবং এক বছরের বেশি সময়ের জন্য অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনতে থাকেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সাধারণত ব্যবসায়ীদের বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ এনে তা সুদে আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। এ ঋণের সুদ আপাতত কম মনে হলেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত কারণে মেয়াদ শেষে সুদহার বেড়ে যায়। যেমন, প্রতি ডলার ৮৪ টাকার বিনিময় মূল্যের সময় একজন ব্যবসায়ী ঋণ নিলেন। এক বছর বা পাঁচ বছর মেয়াদি ঋণ নিলে মেয়াদ শেষে পরিশোধের সময় প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৯০ টাকা হলো। যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়, তখন মুদ্রার বিনিময়মূল্যের কারণে প্রকৃত সুদহার অনেক বেড়ে যায়। তবে, মূলধনী যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিলে প্রকৃত অর্থে লাভ হয়। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ এক বছরের বেশি সময়ের জন্য নিলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ বিডার কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ অনুমোদনের ঝামেলা এড়াতে উদ্যোক্তারা স্বল্প মেয়াদেই বেশি হারে বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছেন, এতে বৈদেশিক মুদ্রার দায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত অলস টাকা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে এ থেকে যে সুদ পরিশোধ করত তা দেশেই থেকে যেত। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর কোনো চাপ বাড়ত না। এতে ব্যাংকগুলোরও তহবিল ব্যয় কমত যা সামগ্রিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়ত। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণ নেয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় সুদ পরিশোধ করছেন। এতে এসব ঋণের সুদ বৈদেশিক মুদ্রায় চলে যাচ্ছে বিদেশে। এ ব্যয় বেড়ে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর পড়বে। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ বাড়তে থাকলে রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও কল্যাণকর হবে না বলে তারা মনে করছেন।

ব্যাংকারোা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ব্যবসায়ীদের দেশী-বিদেশী ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে স্থানীয় ঋণের কিস্তি পরিশোধে যেমন শিথিলতা দেয়া হয়েছে, তেমনি বিদেশী ঋণের কিস্তিও দেরিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় বাড়তি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। বিদেশী ঋণের কিস্তি দেরিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়ায় বেসরকারি খাতে বকেয়া কিস্তির পরিমাণ গত ৬ মাসে বেড়েছে প্রায় ৮৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে যেখানে ডেফার্ড পেমেন্টের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার, সেখানে ৬ মাসের ব্যবধানে জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১২৫ কোটি ২৮ লাখ মার্কিন ডলার। ৬ মাসে বকেয়া কিস্তির পরিমাণ বেড়েছে ৫৮ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, একদিকে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। যেমন গত আগস্টে এক মাসেই বেড়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ। অপর দিকে, বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রায় দায়। এদিকে যে হারে আমদানি ব্যয় বাড়ছে গত তিন মাস এক টানা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গেছে। এর ফলে আমদানি দায় মেটাতে হরহামেশাই ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে গত আড়াই মাসে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ১২৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এর মধ্যে চলতি মাসের ১৩ দিনেই বিক্রি করেছে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। যে হারে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে এ অবস্থা চলতি থাকলে চলতি মাসে ৭০ কোটি ডলার বিক্রি করতে হবে ব্যাংকগুলোর কাছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, অপরদিকে বৈদেশিক ঋণের বাড়তি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। এমনিতেই টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, সামনে ডলারের বিপরীতে এ অবমূল্যায়ন আরো হবে, অর্থাৎ টাকার মান আরো কমে যাবে। সেক্ষেত্রে একই পণ্য কিনতে বাড়তি ব্যয় করতে হবে। অপরদিকে টাকা ডলারের বিনিময় হারের কারণে বৈদেশিক দায় পরিশোধ করতেও বেশি ব্যয় করতে হবে। সবমিলেই লেনদেনের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877